গল্প- মুক্তি

মুক্তি
-সুজাতা দাস

 

 

যেই স্বপ্ন মনে মনে দেখে আরাধ্যা, তা যে পূরণ হবার নয় সেটা নিজেও বোঝে। তাই মাঝে মাঝে নিজের গলা নিজেই টিপে ধরে আরাধ্যা।
যাতে কোনও স্বপ্ন আর না রাখতে পারে সে তার মনের মাঝে, কোনও স্বপ্ন না; কিছুই না। কিন্তু স্বপ্নগুলো কিছুতেই বুঝতে চায় না, কিছু মানুষের যে স্বপ্ন দেখতেও মানা! এটা কি ভাবে বোঝাবে তার স্বপ্নদের আরাধ্যা!
জীবনের প্রতিকূলতাকে ভেঙে এগিয়ে যাওয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়ে মাঝ মাঝেই সেইসব মানুষগুলোর ক্ষেত্রে, যারা স্বপ্ন দেখে কিন্তু স্বপ্ন দেখা বারণ তাদের জন্য। তবুও স্বপ্নেরা নিঃশব্দে আসে, এসে ভীড় করে মনের মধ্যে, যখনই একা একা থাকে আরাধ্যা।

একা থাকতে চায় না কখনও আরাধ্যা, কিন্তু যখনি মানব অফিসের কাজে বেরিয়ে যায় কয়েক দিনের জন্য অফিস ট্যুরে, তখনই এইসব স্বপ্নগুলো ভীড় করে আরাধ্যার একাকিত্বের সুযোগে।
এমন তো ছিল না তার জগৎ, সব কিছু খুব সুন্দর ভাবেই শুরু হয়ে এগিয়ে ছিল।কিন্তু হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলো আরাধ্যা, মানবের মনের কোথাও জায়গা নেই তার। সেখানে রয়েছে অন্য কারো অবস্থান।
যেদিন বুঝতে পারলো প্রথম আরাধ্যা নিজে এই কথাটা, সেদিন নিজের ভেতরটাকে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে যেতে দেখেছিল সেসময়।কিন্তু একবারের জন্যও বুঝতে দেয়নি মানবকে।

নিজের হাতে সাজানো পুরো সংসারটাকে আবার নতুন করে সাজাতে শুরু করেছিল সে, মিথ্যার তাসের ঘর জেনেও। কারণ সময় কাটতে চাইতো না তার, যখন মানব অফিসের কাজে বাইরে যেতো কয়েকদিনের জন্য তাকে একা রেখে, মিথ্যা সংসারটাকেই আরাধ্যা সেই সময় নিজের করে বুকে আগলে রাখতো। জীবনের পাওয়া আর না পাওয়ার হিসাব মেলানো যে খুবই কঠিন, তত দিনে বুঝতে পেরেছিল আরাধ্যা।
তাই জীবনটাকে নতুন করে সাজানোর কথা ভাবতে শুরু করে দিল আরাধ্যা একদম নিশ্চুপে মানবের অগোচরে। কারণ আরাধ্যা এভাবে একজন হেরে যাওয়া মানুষ হিসেবে নিজেকে কখনোই দেখতে চায় নি। তাই মানবের আড়ালে আবার নিজের মতো করে শুরু করলো লেখাপড়া, নিজেকে নতুন করে তৈরি করা যা সে হতে চেয়েছিল।
কয়েক বছরের অনভ্যাস সত্ত্বেও কঠোর পরিশ্রমের ফলে একদিন হেরে যাওয়া নিজেকে দেখলো। জিতে গেল আরাধ্যা চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে। একদিন স্কুলের চাকরিটা পেয়ে গেল হঠাৎ করেই আরাধ্যা, মালদার একটা স্কুলে এপয়েন্টমেন্ট লেটারটা আসার পর প্রথম দু’টো দিন সময় কেটেছে মানবকে কিভাবে বলবে আরাধ্যা এটা ভেবেই, তারপরের দুদিন টিকিট ও আনুষঙ্গিক টুকিটাকি কেনাকাটা করতেই চলে গেল।

হাতে আর মাত্র দু’দিন এটা ভেবেই appointment letter-টা হাতে নিয়ে ঢুকলো মানবের ঘরে। অনেকদিন বাদে এই ঘরটায় ঢুকে দেখলো দরজার দিকে পেছন ফিরে ইজিচেয়ারে বসে আছে মানব। মাত্র তিন বছর হলো বিয়ে হয়েছে ওদের, কিন্তু মনের অনেক গভীরেও যে এই সম্পর্কের অনু মাত্র আর অবশিষ্ট নেই এটা বুঝতে পেরেছিল বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই আরাধ্যা। সম্পর্কের গভীরতা টিকে থাকে বিশ্বাস এর উপর, ঐ শব্দটিই যদি.. ভাবছিল মনে মনে আরাধ্যা।
অনেক সুসম্পর্কের দিন কেটেছে এই ঘরে সেগুলো মনে পড়তে থাকলো আরাধ্যার না ভাবতে চেয়েও, চোখের কোনটা কি ভিজে যাচ্ছে আরাধ্যার! একটু হাসল মনে মনে এখনও ফল্গু বয়ে চলেছে দেখে শুকনো মরুভূমিতে।

অবাক হলেও অনেক কিছুই মনে পড়তে থাকলো আরাধ্যার পরপর আপন মনেই। যেদিন বিয়ে হয়ে এই বাড়িতে এসেছিল আরাধ্যা, বরণ করে ঘরে নেওয়ার জন্য কেউই দাঁড়িয়ে ছিল না দরজায়। অবশ্য এই ঘটনায় অবাক হয়নি আরাধ্যা, যখন দেখতে গিয়েছিলো সেইসময় তাদের বাড়িতে বলেছিল মানব তার নিজের কেউ নেই, দেখতেও গেছিল দুই বন্ধুকে নিয়ে নিজের কেউ ছিল না বলে।
বাবা একটু খুঁতখুঁত করেছিলেন, কিন্তু মায়ের জেদের আগে টিঁকতে পারেননি তিনি, মায়ের একটিই কারণ ছিল পছন্দের, কোনো ঝামেলা নেই সংসারে। নিজের সংসার, শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ, দেবর, কারও উৎপাত নেই, একাই সংসারের মালিক হবে আরাধ্যা।
হয়তো মেয়ের ঝুট ঝামেলাহীন সংসার মায়ের আনন্দের কারণও হয়েছিল সে সময়, আজ যদি মা জানতে পারতেন কতটা অন্তঃসার শূন্য ছিল এই সংসার!

ভাবছিল মনে মনে আরাধ্যা- মানিয়ে নেবারও একটা পরিমাপ থাকে, যেটা লঙ্ঘন করলে আত্মসম্মান হারাতে হয়। এটা যদি মা বুঝতে পারতেন, তাহলে আজ হয়তো এই দিন দেখতে হতো না আরাধ্যাকে কখনও।

তবে আত্মসম্মান হারানোটা, মৃত্যুরই সমান মনে হয়েছিল আরাধ্যার কাছে, যে মানবের হতে পারেনি সে কোন অধিকারে এই সংসারে থাকবে মানবের স্ত্রী হয়ে, তাকে ফিরতেই হবে নিজের জগতে। তাই নিজেই সরে যাবার এই পরিকল্পনা করেছে আরাধ্যা।
আজ অনেক দিন বাদে এই ঘরে ঢুকে শক্ত মনটা কি নরম হচ্ছে! একটু ভাবলো আরাধ্যা। তারপর নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে গলাটা একটু খুকখুক করলো আরাধ্যা। গলার আওয়াজ শুনে ঘুরে আরাধ্যাকে দেখে আবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ মানব, কারণ বহুদিন বাদে আরাধ্যা এই ঘরে পা দিলো। প্রথমে খানিক অবাক হলেও একটু ভেবে নিয়ে তারপর মানব আরাধ্যার দিকে তাকিয়ে বললো, কিছু বলবে?
মানবের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে হাতের খামটা এগিয়ে ধরলো মানবের দিকে আরাধ্যা, মানব চোখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে তাকিয়ে রইলো খানিক খামটার দিকে, তারপর হাত বাড়িয়ে দিল আরাধ্যার দিকে খামটা নেবার জন্য।

খামটা থেকে কাগজটা বার করে দেখে নিয়ে অবাক হয়ে মানব বললো, তুমি চাকরি করবে?
কেন নয়? জিজ্ঞাসা আরাধ্যার।
বার্লো গার্লস স্কুল মালদা? আরাধ্যার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো মানব।
মাথা নাড়লো আরাধ্যা, মুখে হ্যাঁ বললো, সে।
কিন্তু সে’তো অনেক দুর, বললো মানব।
স্কুল কর্তৃপক্ষ সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন চিন্তা করো না, আমি যেতে পারবো।
একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আরাধ্যার দিকে মানব, ভাবলো এতটা মনের জোর পেল কোথা থেকে আরাধ্যা।

একবার জানতেও পারেনি সে, তৈরি করলো কখন নিজেকে আরাধ্যা! মনে মনে ভাবলো মানব।
এবার ট্যুর থেকে ফিরে এসে মানব ঠিক করেছিল সব খুলে বলবে আরাধ্যাকে এবং এরপর কিভাবে চলবে আরাধ্যার সেই ব্যবস্থাও…কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই অন্যরকম হয়ে যাওয়ায় নিজেও কিছুটা অবাক হলো, তবে আরাধ্যাকে দেখে একটু বেশি অবাক হলো মানব।
সেই আরাধ্যা যে একদিন তার স্ত্রী হয়ে এই বাড়িতে এসেছিল, একটা নরম ফুলের মতো মেয়ে কি করে এতটা শক্ত হতে পারলো ভাবতে ভাবতে তাকালো মুখ তুলে আরাধ্যার দিকে মানব- কিন্তু ততক্ষণে আরাধ্যা ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে।
কারণ অনেক গোছানো বাকি আছে তার, কিছু কাজ এখনও বাকি থেকে গেছে যা সে যাবার আগেই শেষ করতে চায়।
মাত্র দুদিন বাকি তাই দাঁড়ানোর প্রয়োজন মনে করেনি আর আরাধ্যা।

রাতের খাওয়া শেষ হলে নিজের ঘরে ঢুকে গোছানো শুরু করলো আরাধ্যা। অবাক হয়ে দেখলো তার বেশির ভাগ জিনিস মানবেরই দেওয়া- তার থেকেই দেখে দেখে গুছিয়ে নিল ঠিক তার যতটুকু প্রয়োজন লাগবে কিছু দিনের জন্য। আজ আর কোনও পুরানো স্মৃতি মনে ঘুরপাক খেল না আরাধ্যার, নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লো অনেক দিন বাদে।

অনেক ভোরে উঠে তৈরি হয়ে নিল সে, একবার ভেবেছিল মানবকে বলে যাবে কিন্তু পরক্ষণেই মত পাল্টালো আরাধ্যা, কারণ তার জন্য মানবের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটুক মানবের তা সে চাইনি, তাছাড়া সম্পর্কের আছেই বা কী। তৈরি হয়ে একটা ছোট্ট সুটকেস আর একটা সাইড ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। দরজা খুলতেই অবাক হয়ে দেখলো, মানব দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে আজ আরাধ্যাকে অবাক করে দিয়ে। মানব হাত বাড়িয়ে ব্যাগটা তুলতে গেলে আরাধ্যা বললো, আমাকেই বইতে দাও এবার, কারণ এর পর তো আমারটা আমাকেই বইতে হবে।

ঝুঁকে সুটকেসটা তুলতে গিয়েও সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো মানব!
মুখে বললো, মানে?
একটু ছোট্ট হেসে আরাধ্যা বললো মানবকে, সব কথার কি মানে থাকে?
ততক্ষণে উবের চলে এসেছে, ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে আরাধ্যা, গাড়িতে ওঠার আগে একবার ফিরে তাকালো সদর দরজার দিকে, একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আপন মনেই আরাধ্যার বুক থেকে। কি হতে পারতো আর কি হলো এই ভাবনা নিয়েই গাড়িতে উঠে বসলো আরাধ্যা, আর সাথে সাথেই স্টেশনের উদ্দেশ্যে গাড়ি এগিয়ে চললো।

আরাধ্যাকে নিয়ে গাড়িটা বেড়িয়ে গেলে দরজা বন্ধ করে আস্তে আস্তে ঘরের দিকে যেতে থাকলো মানব। কিন্তু ঘরে না ঢুকে আরাধ্যার ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো নিজের অজান্তেই। আরাধ্যা যে এভাবে তাকে হারিয়ে দেবে হয়তো ভাবতে পারে নি মানব।
ভেবেছিল অনেক কান্নাকাটি দিয়ে শেষ হবে তার বলতে চাওয়া কথাগুলো- কিন্তু আরাধ্যার চলে যাওয়াটা কিছুটা এলোমেলো করে দিল মানবকে। আরাধ্যার ঘরে ঢুকে দেখলো একটা খাম পড়ে আছে খাটের উপর, একটু অবাক হয়ে ভাবলো কাগজপত্র ফেলে রেখে চলে গেল নাকি আরাধ্যা।

সেটা মনে করে তাড়াতাড়ি খামটা হাতে নিয়ে খুলে ফেললো মানব আর বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ কাগজটার দিকে অবাক হয়ে- অস্ফুটেই বলে উঠলো মানব- “ডিভোর্স পেপার”!!
হাত থেকে পড়ে যাচ্ছিল কাগজটা, তাড়াতাড়ি ধরলো কাগজটাকে মানব আর ঠিক তখনই নজরে এলো কাগজটাতে সই করে দিয়ে গেছে আরাধ্যা।

Loading

Leave A Comment